স্ক্যাবিসের চিকিৎসা

স্ক্যাবিস একটি সংক্রামক চর্মরোগ, যা Sarcoptes scabiei নামক মাইট দ্বারা সৃষ্ট। এর চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত জরুরি। সঠিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। নিচে স্ক্যাবিসের চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হল।

স্ক্যাবিসের ঔষধিভিত্তিক চিকিৎসা

স্ক্যাবিসের চিকিৎসায় সাধারণত নিম্নলিখিত ঔষধ ব্যবহৃত হয়:

১. পারমেথ্রিন ক্রিম (৫%)

  • ব্যবহার: এটি স্ক্যাবিসের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা। ঘাড় থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীরে রাতে ক্রিমটি লাগাতে হয় এবং ৮-১৪ ঘণ্টা রেখে ধুয়ে ফেলতে হয়।
  • প্রয়োগ পদ্ধতি: ত্বক পরিষ্কার ও শুকনো হওয়া উচিত। আঙ্গুলের ফাঁক, কব্জি, বগল, কোমর, নাভি এবং যৌনাঙ্গের মতো এলাকায় বিশেষ যত্ন নিয়ে লাগাতে হবে।
  • পুনরায় ব্যবহার: প্রয়োজনে ৭ দিন পর পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: সামান্য জ্বালাপোড়া বা লালভাব হতে পারে, যা সাধারণত অস্থায়ী।

২. আইভারমেক্টিন

  • ব্যবহার: মুখে খাওয়ার ঔষধ, বিশেষ করে ক্রাস্টেড স্ক্যাবিস বা পারমেথ্রিনে সাড়া না দিলে ব্যবহৃত হয়।
  • ডোজ: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাধারণত একক ডোজ বা দুটি ডোজ (৭ দিনের ব্যবধানে) দেওয়া হয়।
  • সতর্কতা: গর্ভবতী মহিলা বা ১৫ কেজির কম ওজনের শিশুদের জন্য এটি সুপারিশ করা হয় না।

৩. ক্রোটামিটন লোশন বা ক্রিম (১০%)

  • ব্যবহার: পারমেথ্রিনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি কম কার্যকর।
  • প্রয়োগ পদ্ধতি: পরপর দুই রাত ত্বকে লাগিয়ে ধুয়ে ফেলতে হয়।
  • পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: ত্বকে জ্বালাপোড়া বা অ্যালার্জি হতে পারে।

৪. লিন্ডেন লোশন (১%)

  • ব্যবহার: পারমেথ্রিন বা ক্রোটামিটন ব্যবহার সম্ভব না হলে এটি ব্যবহৃত হয়।
  • সতর্কতা: শিশুদের ক্ষেত্রে এটি কম ব্যবহৃত হয় কারণ এটি ত্বকে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে।

৫. অ্যান্টিহিস্টামিন

  • ব্যবহার: চুলকানি নিয়ন্ত্রণের জন্য মুখে খাওয়ার অ্যান্টিহিস্টামিন ঔষধ (যেমন: সিটিরিজিন বা লোরাটাডিন) দেওয়া হয়।
  • উদ্দেশ্য: এটি ঘুমের সময় চুলকানি কমিয়ে আরাম দেয়।

৬. ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের চিকিৎসা

  • অতিরিক্ত চুলকানির ফলে ত্বকে ক্ষত হলে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম বা মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন হতে পারে।

স্ক্যাবিসের স্বাস্থ্যবিধি ও পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা

চিকিৎসার পাশাপাশি সংক্রমণের বিস্তার রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে:

  • কাপড় ও বিছানার চাদর ধোয়া:
    • আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়, তোয়ালে, বিছানার চাদর, বালিশের কভার ইত্যাদি ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে।
    • ড্রায়ার ব্যবহার করলে উচ্চ তাপমাত্রায় শুকানো উচিত।
  • ধোয়া যায় না এমন জিনিস:
    • যেসব জিনিস ধোয়া সম্ভব নয় (যেমন: পশমের কম্বল বা নরম খেলনা), সেগুলো এয়ারটাইট প্লাস্টিক ব্যাগে সিল করে ৭-১৪ দিন রেখে দিতে হবে। এতে মাইট মারা যাবে।
  • পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা:
    • আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকা সবাইকে (যেমন: পরিবারের সদস্য, রুমমেট) একই সময়ে চিকিৎসা নিতে হবে, এমনকি তাদের লক্ষণ না থাকলেও।
  • ঘর পরিষ্কার:
    • ঘরের মেঝে, আসবাবপত্র এবং বাথরুম নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করে কার্পেট বা সোফা পরিষ্কার করা যেতে পারে।

স্ক্যাবিসের ঘরোয়া প্রতিকার

ঔষধের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া উপায় চুলকানি এবং মাইট দমনে সহায়ক হতে পারে। তবে এগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়:

  • নিমপাতার পেস্ট:
    • নিমপাতা পিষে পেস্ট তৈরি করে আক্রান্ত স্থানে লাগান। ৩০ মিনিট রেখে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে ফেলুন। নিমের অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণ মাইট দমনে সহায়ক।
  • রসুন:
    • রসুনের রস আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে ২০-৩০ মিনিট রাখুন, তারপর ধুয়ে ফেলুন। এটি ৩ দিন ব্যবহারের পর ২ দিন বিরতি দিয়ে পুনরায় ব্যবহার করা যায়।
  • অ্যালোভেরা:
    • অ্যালোভেরা জেল ত্বকে লাগালে চুলকানি এবং জ্বালাপোড়া কমে। এটি ত্বককে শান্ত রাখতে সহায়ক।
  • ঠান্ডা পানিতে গোসল:
    • গরম পানি চুলকানি বাড়ায়, তাই ঠান্ডা বা হালকা উষ্ণ পানিতে গোসল করুন।

স্ক্যাবিসের চিকিৎসার সময় সতর্কতা

  • চিকিৎসকের পরামর্শ: ঔষধ বা লোশন ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। শিশু, গর্ভবতী মহিলা বা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ ঔষধের প্রয়োজন হতে পারে।
  • পুনরায় সংক্রমণ রোধ: চিকিৎসার পরেও পরিবেশ পরিষ্কার না হলে পুনরায় সংক্রমণ হতে পারে। তাই কাপড়, বিছানা এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করা জরুরি।
  • চুলকানির ধৈর্য: চিকিৎসার পরও চুলকানি ১-২ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে, যা সাধারণ। এটি “পোস্ট-স্ক্যাবিটিক ইচ” নামে পরিচিত। তবে লক্ষণ বেড়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

স্ক্যাবিসের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

চিকিৎসার পাশাপাশি স্ক্যাবিসের পুনরাবৃত্তি রোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন:

  • নিয়মিত গোসল এবং পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার।
  • ব্যক্তিগত জিনিসপত্র (তোয়ালে, কাপড়, বিছানার চাদর) অন্যের সঙ্গে শেয়ার না করা।
  • জনাকীর্ণ স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
  • লক্ষণ দেখা মাত্র দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

উপসংহার

স্ক্যাবিসের চিকিৎসা সঠিক ঔষধ, স্বাস্থ্যবিধি এবং পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। পারমেথ্রিন বা আইভারমেক্টিনের মতো ঔষধের সঙ্গে ঘরোয়া প্রতিকার এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। পরিবারের সব সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে থাকা ব্যক্তিদের একযোগে চিকিৎসা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। যদি লক্ষণ দীর্ঘায়িত হয় বা জটিলতা দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

Leave a Comment